মানুষ মৃত্যুবরণ করার পর তাকে গোসল করানো, কাফন পড়ানো এবং জানাযার পর দাফন করা হযে থাকে। দাফন করার জন্য কবর খননের ব্যবস্থা করা হয়। মাটি শক্ত হলে বুগলী কবর তৈরী করা উত্তম, নতুবা সাধারণ কবর তৈরী করবে। আসুন তাহলে জেনে নেই দাফনের নিয়ম গুলো:
দাফনের আগে ও পরে কিছু কাজ:
১) সবািই মৃত ব্যক্তির জন্য মনে মনে দু’য়া ইস্তিগফার করতে থাকবে।
২) জানাযা প্রস্তুত হওয়ার সাথে সাথেই ইমাম সাহেব জানাযা নামাযের ব্যবস্থা করবেন। ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপধান বা তার প্রতিনিধি জানাযা নামাযের ইমমতির প্রথম হক্বদার। তারা উপস্থিত না থাকলে মৃতব্যক্তির সন্তান যদি নেককার, পরহেযগার আলেম হন এবং মহল্লার ইমাম থেকে বেশি দীনদার হন, তাহলে তিনিই জানাযার নামায পড়ানোর বেশি হকদার। এজন্য প্রত্যেকেরই উচিত ছেলেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য তাকে খালিস দীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করা। কারণ, নিজের ছেলে যে অন্তর নিয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করবে। এটা অন্য কারো জন্য সম্ভবপর নয়। আর ছেলে যদি এ ধরনের যোগ্যতা সম্পন্ন না হয়, তাহলে মহল্লার ইমাম জানাযার নামায পড়ানোর বেশি হকদার। সুতরাং এরূপ ক্ষেত্রে জানাযার নামায মহল্লার ইমাম সাহেব পড়াবেন। (আদ-দুররুল মুখতার-২/২১৯, আহকামে মায়্যিত-৭৯)।
৩) জানাযা যদি মাকরূহ সময়ে প্রস্তুত হয়, যেমন-সূর্য উঠা, সূর্য মাথার উপর থাকা বা সূর্য ডুবার সময় হয়, তাহলে দাফনে বিলম্ব রহিত করার জন্য সে সময়েই জানাযা পড়ে নিবে। দেরী করার প্রয়োজন নেই। তবে, জানাযা প্রস্তুত হওয়ার পরে অলসতা করে বা কোন কারণে দেরী হওয়ার যদি উল্লেখিত মাকরূহ সময় এসে যায়, তাহলে সে সময় জানাযা পড়বে না। বরং মাকরূহ ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পরে জানাযা পড়বে। তবে, ফজরের নামাযের পর বেলা উঠার আগে ও আসরের পরে বেলা ডুবার পূর্বের সময়টা নফল নামাযের জন্য মাকরূহ সময় হলেও জানাযার জন্য মাকরূহ সময় নয়। সুতরাং সে সময় জানাযার নামায পড়তে কোন অসুবিধা নেই। (হিদায়া-১/৮৬, ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম-৫/৩৩৫)।
জুমুআ বা ফরয নামাযের জামা-আতের পূর্বে জানাযা প্রস্তুত হলে, যদি জানাযা পড়ে দাফন সেরে এসে ফরয নামাযের জামা-আত পাওয়া যায়, তাহলে দাফন কার্য আগে সারতে হবে। তারপর জামাআতে শরীক হবে। এক্ষেত্রে ফরয নামাযের পরে জানাযা নামায পড়ার জন্য দেরী করা নিষেধ। কারণ! এতে দাফন বিলম্বিত হয়। আর যদি দাফন সেরে জামা-আত পাওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে ফরয নামাযের পর জানাযার নামায আদায় করবে। জানাযা নামায সুন্নাতের পরেও পড়া যায় বা ফরয নামাযের পরপরই পড়ে নেয়া যায়। তবে, বর্তমান যমানায় যেহেতু, মানুষের অন্তরে সুন্নাতের তেমন কোন গুরুত্ব নেই বললেই চলে। তাই জানাযার নামাযের জন্য বের হলে অনেকে সুন্নাত থেকে মাহরুম হয়ে যায়, বিদায় ফুকাহয়ে কিরাম সুন্নাত নামাযের পর জানাযা পড়াকে উত্তম বলেছেন। (ফাতাওয়ায়ে শামী-২/১৬৭, আহকামে মায়্যিত-৬৫-৬৬)।
৪) লাশ কবরস্থানে নেয়ার সময় মধ্যম গতিতে চরবে। একেবারে ধীর গতিও নয় আবার খুব দ্রুত গতিও নয়। (ফাতাওয়ায়ে শামী-৩/১৩৬)।
৫) যে স্থানে মৃত্যু হয়েছে মৃত ব্যক্তিকে তার নিকটস্থ কোন গোরস্থানে বা কবরস্থানে দাফন করে দেওয়া। শরঈ কোন উযর ছাড়া দাফনের জন্য দূরে নেয়া নিষেধ। (ফাতাওয়ায়ে শামী-৩/১৪৬)।
৬) মৃত ব্যক্তি মহিলা হলে তার পূর্ণ শরীর ভালভাবে চাদরাবৃত করে রাখবে এবং চাদরাবৃত অবস্থায়ই তাকে কবরে নামাবে, যাতে তার কোন অঙ্গ না-মাহরামদের দৃষ্টিগোচর না হয়।
৭) কোন অসুবিধা না থাকলে মুর্দার খাট কবরের পশ্চিম পার্শ্বে রাখবে এবং সেখান থেকেই মুর্দারকে কবরে নামাবে। আর অসুবিধা থাকলে খাটিয়া যে দিকে রেখে লাশ কবরে নামানো সুবিধা হয়, সেদিকে দিয়েই তাকে কবরে নামাবে। (ফাতাওয়ায়ে শামী-৩/১৩৯)।
৮) কবরে নামানোর পর- بسم الله وعلى ملت رسول الله বলে মুর্দাকে সম্পূর্ণ ডান কাঁতে কিবলামুখী করে শোয়াতে হবে। এটাই সুন্নাত তরীকা। (আবু দাউদ শরীফ, আদ-দুররুল মুখতার-২/২৩৫, ইমদাদুল ফাতাওয়া-১/৪৮৫, আহকামে মায়্যিত-২৩৬)।
উল্লেখিত দু’আর মধ্যে এভাবে শোয়ানোর কথা ঘোষণা করা হলেও আফসোসের কথা হচ্ছে, মুখে তো নবী (সাঃ) এর তরীকায় শোয়ানোর কথা স্বীকার করা হয়। অথচ কাজ করা হয় তার সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাৎ মুর্দাকে চিৎ করে কবরে এমনভাবে শোয়ানো হয়, যা নবী (সাঃ) উম্মতকে শিক্ষা দেননি। সুতরাং মুখের কথার মধ্যে আর কাজের মধ্যে কোন মিল হয় না। এ ব্যাপারে শরীআতের মাসআলা হলো, জীবিত মানুষ যেভাবে সুন্নাত তরীকায় ডান কাতে শয়ন করে, মুর্দাকে সেভাবে কবরে ডান কাঁতে শোয়ানো সুন্নাত। চিৎ করে শোয়ানো এবং ঘাড় মুচড়িয়ে চেহারাটাকে কোন রকমে কিবলামুখী করা শরীআত সম্মত নয় বরং সম্পূর্ণ ডান কাঁতে শোয়াবেন। যাতে স্বাভাবিক ভাবে চেহারা কিবলামুখী হয়ে যায়। এ জন্য বিজ্ঞ আলেম বা মুফতী সাহেবের নিকট থেকে কবর খননের নিয়ম শিখে নেয়া দরকার যাতে ডান কাঁতে শোয়ালে লাশ কোন দিকে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা না থাকে। এ মাসলাটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা আমাদের সবার কর্তব্য। যাতে সকল মুসলমানকে কবরে সহীহ তরীকায় রাখা হয়।
শরীআতের দৃষ্টিতে সীনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সীনার মধ্যে থাকে কলব বা অন্তর। আর কলবের মধ্যেই থাকে ঈমান। সুতরাং সীনাকে কিবলামুখী করে রাখা উচিত। সীনা এত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যে, নামাযে মুখ ঘুরে গেলে নামায মাকরূহ হয়, কিন্তু! নামায ভঙ্গ হয় না। অথচ সীনা ঘুরে গেলে নামায ভঙ্গ হয়ে যায়। সুতরাং বাংলাদেশে সীনা আসমানের দিকে রেখে চিৎ করে শুইয়ে দাফন করার যে গলদ তরীকা চালু হয়ে গেছে তার আশু অবসান হওয়া জরুরী। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী-১১৬৬, রহীমিয়্যাহ-৮/১৭৫)।
৯) যারা দাফন কেরে্য অংশ নিবে, সম্ভব হলে তারা মৃত ব্যক্তির মাথার দিকে ডান হাতে তিনবার মাটি দিবে। প্রথমবার মাটি দেওয়ার সময় পড়বে- منها خلقناكم দ্বিতীয়বার মাটি দেওয়ার সময় পড়বে- وفيها نعيدكم আর তৃতীয়বার মাটি দেওয়ার সময় পড়বে- ومنها نخرجكم تارة اخرى (আহকামে মায়্যিত-৮৯)
১০) দাফন কার্য শেষে মৃত ব্যক্তির মাথার নিকট সূরা বাকারার শুরু থেকে مفلحون পর্যন্ত এবং পায়ের নিকট দাঁড়িয়ে ঐ সূরার শেষ দুই আয়াত অর্থাৎ امن الرسول থেকে শেষ পর্যন্ত পড়বে। (বাইহাকী শরীফ-হাদিস নং-৭০৬৮, তাবরানী শরীফ-হাদীস নং-১৩৬১৩, ইমদাদুল মুফতীন-৪৪৭)।
১১) সম্ভব হলে বেশি আপনজনেরা দাফনের পর কবরের পাশে আরো ঘন্টাখানেক অবস্থান করবে এবং মৃত ব্যক্তির জন্য দু’আয় রত থাকবে যাতে মুনকার-নকীরের সম্মুখে তার প্রশ্নোত্তর সহজ হয়। (আদ-দুররুল মুখতার-২/১৩৭)।
১২) জানাযা নামাযের পর পরিচিত কেউ দাফনে শরীক না হয়ে চলে যেতে চাইলে মৃত ব্যক্তির আওলাদের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে যাবে। (আহসানুল ফাতাওয়া-৪/২১৪)।
১৩) দাফন কার্য শেষ হওয়ার পর সূরা ফাতিহা, সূরা ইখলাস এবং দূরূদ শরীফ ইত্যাদি পড়ে মায়্যিতের জন্য সকলে মিলে দু’আ করতে পারে। (আহসানুল ফাতাওয়া-৪/২২৩)।
১৪) পার্শ্ববর্তী আত্মীয়-স্বজনেরা মৃত ব্যক্তির পরিবারবর্গের জন্য একদিনের খাবারের ব্যবস্থা করবে। কেননা, দুঃখ-বেদনার কারণে মায়্যিতের আত্মীয়দের খাবার পাকানো/রান্না করা এবং তা খাওয়ার দিকে খেয়াল থাকে না। (আযীযুল ফাতাওয়া-৩২৪)।
আল্লাহ তা-আলা আমাদেরকে সহিহ ভাবে সকল কিছু বুঝার এবং আমল করার তাওফিক দান করুক, আমিন।

0 Comments